![]() |
| চর্বি জমার স্থানই বলে দেবে আপনার ক্যান্সার ঝুঁকি কতটা বেশি |
মানুষের শরীরে চর্বি বা ফ্যাট শুধু সৌন্দর্য নষ্ট করে না, বরং নীরবে এক ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিত দেয়। চর্বি জমার ধরণ ও অবস্থান আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের নির্ণায়ক হতে পারে। বিশেষ করে, শরীরের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অতিরিক্ত ফ্যাট জমলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি বলছে-শরীরের কোথায় চর্বি জমছে, সেটিই হতে পারে ক্যান্সার হওয়ার পূর্বাভাস।
চর্বির ধরণ: সাবকিউটেনিয়াস বনাম ভিসারাল
চর্বি মূলত দুই ধরনের-
সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট (Subcutaneous fat)চামড়ার নিচে জমে।
বাইরের দিক থেকে দৃশ্যমান।
তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর, তবে বেশি হলে ডায়াবেটিস ও হার্টের ঝুঁকি বাড়ায়।
ভিসারাল ফ্যাট (Visceral fat)
শরীরের ভেতরে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঘিরে জমে।
এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
কোন স্থানে চর্বি জমলে কোন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে
১. পেট ও কোমরের চর্বি
ভিসারাল ফ্যাটের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার হলো পেটের ভেতর।ঝুঁকি:
কোলন ক্যান্সার
অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার
পাকস্থলীর ক্যান্সার
বৈজ্ঞানিক কারণ:ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়।
শরীরে অতিরিক্ত ইনফ্লেমেশন সৃষ্টি করে।
ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি দ্রুত হয়।২. হিপ ও উরুর অতিরিক্ত মেদ
নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।ঝুঁকি:
জরায়ু ক্যান্সার
কারণ:
হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা থেকে ক্যান্সার সেলের বৃদ্ধি ঘটে।
৩. লিভারের চর্বি (Fatty Liver)
এখন খুব সাধারণ একটি সমস্যা।ঝুঁকি:
লিভার সিরোসিস হয়ে শেষপর্যায়ে ক্যান্সার
কারণ:
দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্যান্সারে রূপ নেয়।
৪. ঘাড় ও পিঠের মেদ
অনেক সময় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সংকেত।ঝুঁকি:
খাদ্যনালীর ক্যান্সার
কারণ:
হরমোনাল সমস্যার ইঙ্গিত বহন করে।
৫. বুক ও বাহুর নিচে চর্বি
পুরুষ ও নারীর জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।ঝুঁকি:
লিম্ফোমা
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: কীভাবে চর্বি ক্যান্সার বাড়ায়?
হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়
ফ্যাট কোষ থেকে অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন উৎপাদন।
ইস্ট্রোজেন-নির্ভর ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
প্রদাহ (Chronic Inflammation)
অতিরিক্ত চর্বি শরীরে ক্রনিক ইনফ্লেমেশন তৈরি করে।
ইনফ্লেমেশন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মিউটেশন বাড়ায়।
উচ্চ ইনসুলিন লেভেল ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়
স্থূলতা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে।
গবেষণার প্রমাণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানায়, প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ক্যান্সারের ঘটনা অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার কারণে ঘটে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুযায়ী, পেটের ভিসারাল ফ্যাট কোলন ও প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩০-৪০% পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
ইউরোপিয়ান ক্যান্সার জার্নাল দেখিয়েছে, অতিরিক্ত ফ্যাট কোষে জমা হরমোন ক্যান্সার কোষকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখে।প্রতিরোধ ও করণীয়
১. সঠিক খাদ্যাভ্যাস
কম ক্যালোরি ও কম তেলযুক্ত খাবার খাওয়া।
বেশি পরিমাণে সবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত শস্য খাওয়া।
প্রসেসড খাবার ও মিষ্টি কমানো।
২. নিয়মিত ব্যায়াম
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম।
সপ্তাহে ৫ দিন কার্ডিও ও ২ দিন স্ট্রেন্থ ট্রেনিং।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ
BMI (Body Mass Index) ১৮.৫–২৪.৯ এর মধ্যে রাখা।
কোমরের মাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা (পুরুষদের জন্য < ৪০ ইঞ্চি, নারীদের জন্য < ৩৫ ইঞ্চি)।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম।
অনিদ্রা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
৫. মানসিক চাপ কমানো
মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও হবি তৈরি করা।
অতিরিক্ত স্ট্রেস ওজন ও চর্বি বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞের মতামত
ডা. সায়মা রহমান, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ
“ভিসারাল ফ্যাট বা পেটের ভেতরের চর্বি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এটি শুধু ডায়াবেটিস নয়, বরং বিভিন্ন ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও নীরব ঘাতকের ভূমিকা রাখে।”
ডা. মোঃ আশিকুল ইসলাম, হেপাটোলজিস্ট
“ফ্যাটি লিভারকে অবহেলা করলে এটি লিভার ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায়। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা বদলানো ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর উপায় নেই।”
উপসংহার
চর্বি সবসময় খারাপ নয়, কারণ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফ্যাট প্রয়োজন। তবে শরীরের কোথায়, কীভাবে এবং কতটা চর্বি জমছে সেটিই আসল বিষয়। পেট, কোমর বা লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও সচেতনতা-এই চারটি অভ্যাসই আমাদের ক্যান্সার প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

0 Comments